চালের দাম গত ১১ বছরে রেকর্ড ছাড়িয়েছে চরম ঝুঁকিতে বিশ্বের কোটি কোটি সীমিত আয়ের মানুষ

rice-prices.png

দেশের তথ্য ডেস্ক :- বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহ, খরা, অতিবর্ষণ ও তার ফলে সৃষ্ট বন্যার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার শস্য চুক্তি অকার্যকর হয়ে যাওয়া ও ভারত চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় ইতোমধ্যে ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা।

গম ও চালের বাজারে অস্থিরতার আভাস মিলেছে উল্লেখ করে তারা বলছেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন চালের দাম গত ১১ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে ১৭ জুলাই রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে শস্য চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর পর গত ৬ দিনে বিশ্ববাজারে গমের দাম বেড়েছে ৬ শতাংশ। সেইসঙ্গে ইউরোপ-এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির জেরে ভোজ্যতেল, মাংস, চিনি, দুধ, ডিম ইত্যাদি নিত্যপণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন বিশ্বের কোটি কোটি সীমিত আয়ের মানুষ।

যুক্তরাজ্যের সরকারি থিংকট্যাংক সংস্থা চ্যাথাম হাউসের খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগের বিশেষজ্ঞ টিম বেনটন সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে বলেছেন, ‘খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির একটি বড় কারণ বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি। এই মুহূর্তে আমরা মূল্যস্ফীতিজনিত ভোগান্তির শিকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু যদি এই সমস্যা যদি মিটে যায় তাহলেও বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হবে না। সেক্ষেত্রে বর্তমানে যেসব খাদ্যপণ্যের দাম হু-হু করে বাড়ছে, এই বৃদ্ধির গতি হয়তো খানিকটা কমে আসবে; অর্থাৎ ধীরে ধীরে বাড়বে খাদ্যপণ্যের মূল্য এবং তার প্রধান কারণ- জলবায়ু বিপর্যয়জনিত কারণে কৃষি উৎপাদন হ্রাস।’

উল্লেখ্য, চলতি বছর গ্রীষ্মকাল শুরু হতে না হতেই আবহাওয়াগত নানা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। কোনো কোনো অঞ্চলে শুরু হয়েছে দীর্ঘ টানা তাপপ্রবাহ। আবার কিছু অঞ্চলে অতিবর্ষণজনিত কারণে বন্যা শুরু হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনগত এসব বিপর্যয় ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদনব্যবস্থার ওপর। টানা তাপপ্রবাহের কারণে দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোতে দুধ-ডিমের উৎপাদন হচ্ছে কম, টমেটো ও অন্যান্য সবজি ক্ষেতগুলোতে রীতিমতো বিপর্যয় নেমে এসেছে এবং গমের উৎপাদন হয়েছে বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেক কম।

দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোর কৃষি উৎপাদনের বিপর্যয় গোটা ইউরোপের জন্যই অশনিসংকেত। কারণ এই অঞ্চলের দেশগুলোই ইউরোপের অন্যান্য দেশের সবচেয়ে বড় খাদ্য যোগানদাতা। এছাড়া টানা তাপপ্রবাহের কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ চীনের ধানক্ষেতগুলো।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশটিতে যে পরিমাণ গম উৎপন্ন হয়েছে- তা গত ৩ দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ কৃষিনির্ভর দেশ ইতালির কৃষকদের সংগঠন কলদিরেত্তি ব্লুমবার্গকে জানিয়েছে, টানা তাপপ্রবাহ ও খরার কারণে গত বছর দেশটির কৃষিতে ৬৭০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপের ফল ও গমের বাজারে একটি বড় সরবরাহ আসে ইতালি থেকে। কলদিরেত্তিতে কর্মরত কৃষি অর্থনীতিবিদ লরেঞ্জো বাজ্জানা জানান, চলতি বছর টানা তাপপ্রবাহের কারণে আঙুর, তরমুজসহ বিভিন্ন ফলের ক্ষেত প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, মধু এবং গমের উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে।

ব্লুমবার্গকে লরেঞ্জো বাজ্জানা বলেন, ‘এটা কোনো স্বাভাবিক গ্রীষ্মকাল নয়। গত কয়েক দশকের মধ্যে এত গরম গ্রীষ্মকাল আমরা দেখিনি। সবাই পরামর্শ দিচ্ছে- তাপমাত্রা সহনশীল ফসল চাষ করতে, কিন্তু এত দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে কী ফসলের নতুন জাতের উদ্ভাবন সম্ভব?’

এদিকে, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে ধানের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাওয়ায় ভারতের অভ্যন্তরেও বেড়েছে চালের দাম। রাজধানী দিল্লির খুচরা বাজারগুলোতে প্রতি কেজি চাল যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। এছাড়া দেশজুড়ে এই বৃদ্ধির হার গড়ে ৯ শতাংশ।

অন্যদিকে খরার কারণে এশিয়ার অপর বৃহৎ চাল উৎপাদনকারী দেশ থাইল্যান্ডের সরকার দেশটির কৃষকদের দুই মৌসুমের পরিবর্তে এক মৌসুম ধান চাষের পরামর্শ দিয়েছে এবং চীনের সরকার কৃষকদের নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ধান কাটার নির্দেশ দিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শনিবারের এক বক্তৃতায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় সরকারি কর্মকর্তাদের আরও তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

Share this post

PinIt
scroll to top