দেশের তথ্য ডেস্ক :- গ্রামজুড়ে মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। অনেকটা প্রকাশ্যে চলছে ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য বেচাকেনা। আছে প্রতারকচক্রও। কেউ মুখ খুললে চলে হেনস্তা, মারধর।
দেওয়া হয় হত্যার হুমকি। এমন পরিস্থিতিতে অসহায় ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন গ্রামের সাধারণ মানুষ। মাদক ব্যবসায়ী ও প্রতারকদের কয়েকজন পুলিশের সোর্স বলে জানিয়েছে গ্রামের বাসিন্দারা।
ভুক্তভোগীরা বলছে, এসব মাদক ব্যবসায়ী গ্রামের যুবসমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন।
তাঁদের সহযোগিতায় একটি চক্র ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যমে নিরীহ লোকজনকে হয়রানি ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই গ্রামের ছেলেমেয়ের বিয়েশাদি এখন হুমকির মুখে। এতে অভিভাবকরা বেকায়দায় রয়েছেন।
পুলিশ বলছে, এই মাদক ব্যবসায়ী ও প্রতারকদের বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার করা হলেও জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে আবার একই কাজ করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডুমাইন গ্রামের বাসিন্দা সরকারি এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীসহ শতাধিক প্রতারকের কাছে সারা গ্রামের মানুষ জিম্মি। তাদের কারণে মান-সম্মানের ভয়ে অন্তত ১০ জন সরকারি কর্মকর্তা (বিসিএস ক্যাডার) গ্রামে যেতে পারছেন না। এর আগে বিভিন্ন সময় তাদের অপকর্মের প্রতিবাদ করে তাঁরা নাজেহাল হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হুমকি পেয়েছেন।’
গ্রামের বাসিন্দা সবুর শেখ (ছদ্মনাম) বলেন, ‘পুরো গ্রামকে গ্রাস করে ফেলেছে মাদক ব্যবসায়ী আর প্রতারকচক্রের সদস্যরা।
প্রতিবাদ করলে হত্যার হুমকি দেয়। আমাদের সঙ্গে এখন অন্য গ্রামের মানুষ বিবাহের সম্পর্ক গড়তে চায় না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১০ বছর ধরে ফরিদপুরের মধুখালী ও ভাঙ্গা উপজেলা এবং সংলগ্ন মাগুরা ও রাজবাড়ী জেলার কিছু গ্রামে এই মাদক ব্যবসায়ী ও প্রতারকচক্রের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। ডুমাইন গ্রামের মিঠুন নামের এক যুবক মাদক ব্যবসার পাশাপাশি ডিজিটাল অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারণা করা চক্রের হোতা। তিনি স্থানীয় থানা পুলিশের সোর্স হিসেবেও কাজ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা সোর্স হিসেবে মিঠুনের কাজ করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সূত্র বলছে, হান্নান, সোহাগসহ কয়েকজন স্থানীয় যুবক মিঠুনের সহযোগী। তাঁরা আগে কৃষিকাজসহ অন্যান্য পেশায় ছিলেন। তাঁদের আর্থিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন দেখে অন্যান্য যুবকও মাদক ব্যবসা ও প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
মধুখালী থানা পুলিশের তথ্য মতে, গত দুই বছরে অনেক শিক্ষিত সচেতন মানুষও এই প্রতারকদের ফাঁদে পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, আমলা, এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাও রয়েছেন।
ঢাকার অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও ফরিদপুর জেলা পুলিশের সূত্র জানায়, প্রতারণা নিয়ে ডুমাইন গ্রামের বিভিন্নজনের নামে অন্তত ২১টি মামলা রয়েছে। বিভিন্ন অভিযানে ১৫০ জনের বেশি মাদক ব্যবসায়ী ও প্রতারক গ্রেপ্তার হয়েছেন। ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি ৯৫ জনকে আত্মসমর্পণও করিয়েছিল পুলিশ। এতেও কাজ হচ্ছে না।
অভিযোগ রয়েছে, এই চক্রের আলী মোল্লা, টিটু, হাসানুজ্জামান, মো. মোক্তার, মো. শামসু, মনসুর, খান ওরফে জাফর, লিংকন, মিজান, ইলিয়াস, মোয়াজ্জেম, সেলিম, পিরোজ, লিটন, শিমুলসহ ডুমাইন গ্রামের অন্তত ৩৭ জন পুলিশের সোর্স। এ কারণে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে অভিযোগ দিয়েও দীর্ঘদিনের এই সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না।
গ্রামটির এক মাদক ব্যবসায়ীর নাম মনসুর। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই গ্রামের অন্তত ৭০ জন বিভিন্ন বয়সী ব্যক্তি মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। নগদ টাকার লোভে তাঁরা মাদক ব্যবসা করেন।
মাদকের কারণে যুবসমাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে—এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এতে আমার কোনো সমস্যা নেই। যেভাবেই হোক, টাকা এলেই আমি খুশি।’
মনসুরের দাবি, স্থানীয় থানা পুলিশের পাশাপাশি জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের টাকা দিয়ে তাঁরা মাদক ব্যবসা করছেন।
জানতে চাইলে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. শাহজাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই গ্রামের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও প্রতারণার অভিযোগ অনেক পুরনো। এ কারণেই গ্রামটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। মাদক নিয়ন্ত্রণে এই গ্রামের ওপর বিশেষ নজরদারি রয়েছে আমাদের।’
এ সময় টাকা দিয়ে মাদক ব্যবসা চালানোর তথ্য সঠিক নয় জানিয়ে এসপি মো. শাহজাহান বলেন, ‘এই চক্র এতই বিস্তৃত যে কয়েক বছর ধরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে অনেক মাদক ব্যবসায়ী এবং প্রতারকচক্রের সদস্যদের আমরা গ্রেপ্তার করেছি।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ডুমাইন গ্রামে রাস্তার দুই পাশে নতুন নতুন পাকা ও আধাপাকা বাড়ি। একতলা ও দোতলা বাড়িগুলোর কোনোটায় বাহারি রং। জানা যায়, গ্রামের নান্টু চৌধুরী, তাঁর তিন ছেলে এবং টিটু, ইকবাল শেখ, আবদুল কাদের শেখ, আরিফুল, লিটন, ইসমাইল, রতন বাবু, মালেক, মানিক, মল্লিক ও ফিরোজ হঠাৎ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাঁদের কেউ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোননি, প্রকাশ্য কোনো পেশাও নেই তাঁদের।
স্থানীয় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বলে আলোচিত আলী মোল্লা সম্পর্কে জানা যায়, মাদকদ্রব্য বিক্রির অভিযোগে ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিনি জেলে যান। এ সময় তাঁর স্ত্রী মাদক ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকেন। পরে আলী মোল্লা জামিনে বেরিয়ে আসেন। একসময় তাঁর বাড়িতে জীর্ণ টিনের ঘর ছিল। এখন সেখানে পাকা ঘর।
এ ব্যাপারে আলী মোল্লার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত নই।’
গ্রামটির কয়েকজন মুরব্বি বলেন, এই মাদক ব্যবসায়ীরা খুব খারাপ। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই মারধর করে। ভয়ে এলাকার কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।
ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গ্রামে মাদক ব্যবসায়ী ও প্রতারকচক্র থাকায় আমরা চরম বিব্রতকর অবস্থায় আছি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সহযোগিতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।’
তাঁর তথ্য মতে, ডুমাইন গ্রামে ভোটার আছেন সাড়ে চার হাজার। গ্রামের বেশির ভাগ লোক মাদক ব্যবসা ও প্রতারণায় জড়িত। হাত বাড়ালেই মাদকদ্রব্য পাওয়া যায় বলে বিভিন্ন উপজেলা, এমনকি জেলা শহর থেকেও বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ এই গ্রামে মাদক কিনতে আসে। মাদকদ্রব্যের ক্রেতাদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অনেক।
এ ব্যাপারে মধুখালী থানার ওসি শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এই গ্রামের লোকজনের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। এসব নিয়ন্ত্রণে আমাদের চেষ্টা চলছে।’
দেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গত ১৪ জুন সচিবালয়ে আইন-শৃঙ্খলাবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে আলোচনা করা হয়। পরে কমিটির সভাপতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাসহ সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও মাদকসেবীর সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। শহর থেকে গ্রামেও মাদক ছড়িয়ে পড়েছে। এর বিরুদ্ধে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৮০ লাখের বেশি। এর ৮০ শতাংশই যুবক। মোট মাদকাসক্তের মধ্যে ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত। জেলখানায় যত মানুষ আছে, এর ৮০ শতাংশই মাদক পাচারকারী বা ব্যবসায়ী।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশের প্রতিটি জেলা, থানা ও গ্রামে বর্তমানে মাদক ছড়িয়ে পড়েছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ ধরনের মাদকের মধ্যে ইয়াবা বেশি সেবন করা হয় জানিয়ে সূত্র বলছে, দেশে প্রতিদিন প্রায় ৭০ লাখ ইয়াবা বিক্রি হয়। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় বিক্রি করা হয় অন্তত ১৫ লাখ ইয়াবা।
এই অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্পটে সক্রিয় অন্তত সাড়ে তিন হাজার মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন মধুখালী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি]