দেশের তথ্য ডেস্ক :- মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মাদকাসক্ত ব্যক্তি শনাক্ত করতে মাদকাসক্তি পরীক্ষা বা ডোপ টেস্ট করতে একটি বিধিমালা প্রণয়নের কথা। কিন্তু ২০১৮ সালে আইন পাস হলেও গত পাঁচ বছরে বিধিমালাটি চূড়ান্ত করা হয়নি। ফলে সরকারি-বেসরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে যে মাদকাসক্তি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল তা হচ্ছে না। তবে সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে।
বিধিমালা চূড়ান্ত করতে এত দেরি হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ একটি ডোপ টেস্ট প্রকল্প করতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। প্রকল্পটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিধিমালা চূড়ান্ত করার কাজ পিছিয়ে গেছে। বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়ায় কত টাকায়, কোন হাসপাতালে ডোপ টেস্ট করা যাবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা থাকছে না।
অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত মাদকাসক্তদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। কারণ শুধু মাদক গ্রহণ ও পরীক্ষার সময়ের হেরফের হলেই বিদ্যমান পদ্ধতির ডোপ টেস্টকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসাকরা। এ অবস্থায় নতুন নিয়োগ পাওয়া সরকারি চাকরিজীবী এবং সব ধরনের গাড়িচালককে ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে কয়েকটি হাসপাতালে। মাদকাসক্তির প্রমাণ মেলায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুতও করা হয়েছে।
কেন ডোপ টেস্ট
দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। নির্ভরযোগ্য তথ্য বা গবেষণা না থাকলেও জনমনে এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত যে গাড়িচালকদের একটি অংশ মদ বা অন্য কোনো মাদক খেয়ে গাড়ি চালায়। অনেক চালক গাড়ি চালানোর সময় বেসামাল থাকেন। ডোপ টেস্টের আওতায় আনলে চালকরা মাদক কম নেবেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমবে।
সরকারি চাকরিজীবীদের কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন—এমন খবর গণমাধ্যমেও এসেছে।
সরকার একে গুরুতর সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করেছে। ২০২০ সালে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গাড়িচালকদের জন্য মাদক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার কথা বলেছিলেন। এর আগে ২০১৮ সালে সরকারের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যাংক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিসিএস ক্যাডার, নন-ক্যাডার সরকারি যেকোনো চাকরিতে যোগদানের আগে অবশ্যই ডোপ টেস্ট করতে হবে। গাড়ির কয়েক লাখ চালক ও সরকারি চাকরিপ্রার্থীর ডোপ টেস্ট দরকার। কিন্তু ডোপ টেস্ট করার সক্ষমতা সব হাসপাতালের নেই।
কোন পর্যায়ে বিধিমালা
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, তারা ডোপ টেস্ট বিধিমালা প্রণয়নের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে একটি খসড়া পাঠিয়েছিল। সুরক্ষা বিভাগ তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল। আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ খসড়া বিধিমালাটি সংশোধনের জন্য ফেরত পাঠায়। এরপর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর সংশোধিত বিধিমালাটি আবার সুরক্ষা সেবা বিভাগে পাঠায়। এখন তা সুরক্ষা সেবা বিভাগে আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাদক অনুবিভাগ) মো. সাইফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, সংশোধিত বিধিমালাটি এখনো আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। বিধিমালাটি পরিমার্জনের জন্য আরো একটি বৈঠক হবে। এরপর বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কবে সেটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
পাঁচ বছরেও ডোপ টেস্ট বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম বলেন, একটি বিধিমালা তৈরির অনেকগুলো পর্যায় আছে। সে জন্য সময় লাগছে। তিনি বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমি মাদক অনুবিভাগে যোগদান করেছি। তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে হলে আমাকে আরো জেনে বলতে হবে।’
বিধিমালার আগেই আসছে ডোপ টেস্ট প্রকল্প
সুরক্ষা সেবা বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ডোপ টেস্ট নিয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। ডোপ টেস্টসংক্রান্ত প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে ডোপ টেস্ট বিধিমালা তৈরির কাজটি কিছুটা পিছিয়ে গেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ডোপ টেস্ট প্রকল্প এবং ডোপ টেস্ট বিধিমালা দুটি বিষয় একসঙ্গে ছিল। প্রকল্পটি এখন একনেকের তালিকাভুক্ত হয়ে আছে। শিগগির চূড়ান্ত অনুমোদন হতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্প ও বিধিমালার প্রস্তাব সুরক্ষা সেবা বিভাগে একসঙ্গে পাঠানো হয়েছিল যৌক্তিক কারণে। পরে সিদ্ধান্ত হয় আগে প্রকল্পটা হোক। প্রকল্পটা হলে সক্ষমতা আসবে। এতে বিধিমালা বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। বিধিমালা ছাড়া ডোপ টেস্ট হচ্ছে কিভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনে তো বলা আছে ডোপ টেস্ট করতে হবে। সে হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ডোপ টেস্ট করছে।’
আইন আছে, বিধিমালা নেই
বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য কেনাবেচা ও সেবন রোধে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮’ প্রয়োগ করা হয়? আইনটি করা হয় ১৯৯০ সালে? পুরনো আইনে ডোপ টেস্ট নিয়ে কোনো কথা না থাকলেও নতুন আইনে ডোপ টেস্ট সম্পর্কে দুই জায়গায় বলা হয়েছে?
২৪(৪) ধারায় বলা হয়েছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তি শনাক্ত করার জন্য বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ডোপ টেস্ট করা যাবে? ডোপ টেস্ট পজিটিভ হলে ধারা ৩৬(৪) অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে? এই ধারায় বলা আছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে আদালত চিকিৎসার জন্য পাঠাতে পারবেন? তিনি চিকিৎসা গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁকে ছয় মাস থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া যেতে পারে। আইনের ৬৮ ধারায় সরকারকে ডোপ টেস্ট সম্পর্কে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে? কিন্তু পাঁচ বছরেও তা হয়নি।
কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের প্রধান পরামর্শক ডা. শোয়েবুর রেজা চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নবনিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী ও গাড়িচালকদের ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে। জনবলের অভাবে সরকারি সব মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে ডোপ টেস্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য বেসরকারি চাকরিজীবীদেরও ডোপ টেস্ট করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে কয়েকটি হাসপাতালেও ডোপ টেস্ট চলছে। বিধিমালা না হওয়ায় নিজ নিজ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল তাদের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (নিরোধ শিক্ষা) মানজুরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন জরুরি প্রয়োজনে ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে। বিধিমালা হলে চূড়ান্তভাবে বলা থাকবে কত টাকায় কোন পদ্ধতিতে, কোথায়, কিভাবে ডোপ টেস্ট করা যাবে।
পাঁচ বছরে দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য ডোপ টেস্টে পজিটিভ
সারা দেশে মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করতে ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে। পুলিশ বিভাগে যাঁরা নতুন চাকরিতে আসছেন তাঁদের ডোপ টেস্ট দিয়েই চাকরিতে যোগ দিতে হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্যের মধ্যে এ পর্যন্ত ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়েছে দেড় শতাধিক। যাঁরা চূড়ান্তভাবে পজিটিভ হয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্তত ৪৫ জন সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছেন। পুরোপুরি চাকরিচ্যুত হয়েছেন ১৮ জন। আরো কয়েকজনকে চাকরিচ্যুত করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এ পর্যন্ত বিভাগীয় শাস্তি ও সতর্ক করা হয়েছে অন্তত ৬০ জনকে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মনজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, সারা দেশে মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্য শনাক্ত করতে তাঁদের ডোপ টেস্ট অব্যাহত আছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, সারা দেশের মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্য ও মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা ডিজিটাইজড করার জন্য এরই মধ্যে দেশের ৬৪ জেলার পুলিশের ইউনিটগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে বলা হয়েছে, মাদকাসক্ত সদস্যরাই সাধারণত নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এ জন্য ডোপ টেস্টের মাধ্যমে পুলিশের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান চালানো হচ্ছে।
জানতে চাইলে ডিএমপির (মিডিয়া) অতিরিক্ত উপকমিশনার কে এন নিয়তি রায় গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ডিএমপিতে ডোপ টেস্ট অব্যাহত রয়েছে। কোনো পুলিশ সদস্যকে মাদক নিচ্ছেন এমন সন্দেহ হলে তাঁকে ডোপ টেস্টের আওতায় নেওয়া হয়।
চালকদের ডোপ টেস্ট
২০২২ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে পেশাদার (বাস-ট্রাকের) ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সরকারি ও আধাসরকারি হাসপাতাল এবং ল্যাবরেটরিগুলোতে ডোপ টেস্টের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকা শহরের ছয়টি হাসপাতাল ও সরকারের মাদক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের অনুমোদিত সব ল্যাবরেটরিতে মাদক পরীক্ষা করা যাচ্ছে।
হাসপাতালগুলো হলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল।
ডোপ টেস্টে পাস করলেই কেবল ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়ায় এগোনো যায়। যদিও অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক নয়। তবে এই ডোপ টেস্টের প্রক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে।