দেশের তথ্য ডেস্ক :- সারা দেশে গত ছয় বছরে মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, নির্বাচনি সহিসংতা, সীমান্তে বিএসএফের হামলা, পারিবারিক সহিংসতা, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা এবং গণপিটুনির ঘটনায় ৫৮৭ জন নিহত হয়েছেন। সম্প্রতি মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) ছয় মাসের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ তথ্যকে উদ্বেগজনক বলছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) ষান্মাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ছয় মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪২০টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৮ জন ও আহত হয়েছেন কমপক্ষে তিন হাজার ৮৮৮ জন। যার অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দল এবং বিএনপির পদযাত্রা ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে আ.লীগের পালটা শান্তি সমাবেশকেন্দ্রিক সংঘর্ষে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। তা ছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দ্বারা দুই হাজার ৯ জন রাজনৈতিক গ্রেপ্তারের শিকার হন, তন্মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের এক হাজার ৮৪৮ জন। একই সময়ে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৩৭টি মামলায় তিন হাজার ৮৪৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরো ২০ হাজার ৬২০ জনকে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের দ্বারা বিরোধীদলীয় ১২৬টি সভা-সমাবেশ আয়োজনে বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় তাদের সাথে সংঘর্ষে এক হাজার ২২৮ জন আহত এবং সমাবেশকেন্দ্রিক ৮৫৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়াও নির্বাচনি সহিংসতার ৩৭টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন চারজন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩০১ জন।
জানুয়ারি থেকে জুন এ ছয় মাসে ৯৬টি হামলার ঘটনায় ১৫৫ জন সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় সন্ত্রাসীদের হামলায় সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম নিহত হয়েছেন। গত ছয় মাসে সাংবাদিক আহত হয়েছেন অন্তত ৮৪ জন, লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন ৬০ জন, হুমকির শিকার হয়েছেন ছয়জন ও গ্রেপ্তার চারজন। একই সময়ে আশঙ্কাজনকভাবে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর অধীনে দায়ের করা ৩৫টি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছেন ৪২ জন এবং অভিযুক্ত করা হয়েছে ১০৪ জন। এ ছাড়া ‘সংখ্যালঘু’ সমপ্রদায়ের ওপর ১২টি হামলার ঘটনায় আহত হয়েছেন আটজন এবং ১২টি মন্দির ও ১৪টি বসতবাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় একজন নিহত ও অন্তত ৬০ জন আহত হয়েছেন। এ হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ১০১টি বাড়ি ও ৩০টি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
‘গণপিটুনির’ ৫৮টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪১ জন এবং আহত হয়েছেন ৪৩ জন। এ সময়ে ৪২টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় গাজীপুরে শ্রমিক নেতা শহিদুল ইসলামসহ নিহত হয়েছেন ১৬ জন এবং আহত হয়েছেন ৫৭ জন। এ ছাড়াও ‘ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)’ কর্তৃক ২৮টি হামলার ঘটনায় ১৩ জন বাংলাদেশি নিহত এবং ১৪ জন আহত ও ছয়জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এক হাজার ২৪৯ জন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫৩৯ জন, ১৮ বছরের কম বয়সি ৩১৭ জন। এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে, ৮৪ জন নারী ও শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৩ জনকে, যাদের মধ্যে শিশু ১২ জন। ৩৮৫ জন নারী ও শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তন্মধ্যে শিশু ২২৭ জন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৬ জন নারী এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩২ জন ও আত্মহত্যা করেছেন চারজন। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ১৩৬ জন, আহত হয়েছেন ৫৭ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ৫৬ জন নারী। এসিড সহিংসতার শিকার হয়েছেন চারজন নারী।
সমাজে আইনের শাসনের অভাবে অন্যায়-অত্যাচার ও জুলুম বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘যেকোনো সমাজে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে গেলেই এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা দেয়। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা কমে গেলেই মানুষ যেকোনো অন্যায় কাজ করতে পারে। দুর্নীতির রাহুগ্রাস সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। মানসিকভাবে মানুষ অসিষ্ণু হয়ে উঠছে। ফলে পাশবিকতা বেশি দেখা যাচ্ছে। আইনের প্রতিও মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। অন্যায়ের যথার্থ সুরাহা না পাওয়ায় মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা খুবই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সাংবাদিকরাই হচ্ছে সমাজের দর্পণ। তাদের ওপর হামলা করা মানেই সত্য প্রকাশে বাধাগ্রস্ত হওয়া। বর্তমানে রাজনৈতিক সহিংসতা ব্যাপক আকারে বেড়ে গেছে। শুধু সরকার ও বিরোধীরাই সংঘর্ষে জড়াচ্ছে না নিজে দলের ভেতরেও অনেক অন্তঃকোন্দল দেখা যাচ্ছে। এতে রাজনৈতিক সৌন্দর্য বিনষ্ট হচ্ছে। সীমান্তে মানুষ হত্যা— এটি আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়। অন্যান্য দেশের সীমান্তে তো এভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে না। এমনকী আমাদের মিয়ানমার সীমান্তেও মানুষ মারা যাচ্ছে না। কিন্তু ভারতের সীমান্তে এত মানুষ মারা যাওয়ার কারণ কী? ভারত থেকে এ দেশে মানুষের আসার প্রবণতা কম। কিন্তু আর্থ-সামাজিক কারণে এ দেশের অনেক মানুষ অবৈধভাবে ভারতে যেতে চায়। সীমান্তে মারা যাওয়া সবাই অসচ্ছল পরিবারের। এই মানুষগুলোর কথা আমাদের ভাবতে হবে।’
এ ব্যাপারে আইন ও সালিশকেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, ‘সংগঠনটি যে তথ্যগুলো উঠিয়ে নিয়ে এসেছে এটা তো প্রকৃত চিত্র নয়। এটি পত্র-পত্রিকায় আসা চিত্র। এর বাইরের অনেক ঘটনা আছে যা আমরা জানি না। নির্বাচনের আগে এরকম সহিসংতার ঘটনা বেড়ে যাওয়া খুবই উদ্বেগজনক। অনেক হামলা মামলার ঘটনাও বেড়েছে। এতে দেশে মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।’