দুর্লভ ভেষজ লতাকস্তুরী, দেখা মিলল গৌরনদীতে

vashoj.webp

দেশের তথ্য ডেস্ক:- কস্তুরীর নাম শুনলে বিশেষ এক প্রজাতির হরিণের নাভির সুগন্ধিকে বোঝায়। লতাকস্তুরী আসলে হরিণের নাভি নয়, এটি একটি মূল্যবান ঔষধি গাছ। লতাকস্তুরীর বীজের স্বাদ, গন্ধ এবং এর সৌরভ মোহনীয় করে তোলে সকলকে। এর বীজে কস্তুরীর ঘ্রাণের মিল থাকায় হয়তো লতা কস্তুরী নাম হয়েছে।

একসময় আমাদের দেশে এর চাষ ছিল। অজ্ঞতা আর অবহেলায় লতা কস্তুরী বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। লতাকস্তুরীর ভেষজগুণ অকল্পনীয়। বিভিন্ন ভেষজশিল্পে এর ফল, বীজ, শিকড়, পাতা ও কাণ্ডের বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে।

লতা কস্তুরীর আঁশ দিয়ে এক সময় ছিকা, জায়নামাজসহ কুটিরশিল্প ভিত্তিক বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা হতো।
আখের গুড় স্বচ্ছ ও পরিষ্কার করার জন্য লতা কস্তুরীর পাতা, কচি ডগার নির্যাস ব্যবহার করা হতো। বিলুপ্তপ্রায় এই ভেষজ রাস্তার পাশে পরিত্যাক্তভাবে জন্মাতে দেখা যায়। অথচ আমাদের দেশে এর বীজের অনেক চাহিদা রয়েছে যা আমদানি নির্ভর।

প্রকৃতির ধন লতাকস্তুরী Abelmoschus moschantus পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। স্থানভেদে লতাকস্তুরী, কালাকস্তুরী, মুসকদানা, জটাকস্তুরি, বেন্ডা, কসুক, বনঢেরশ নামে পরিচিত। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এর নাম লতাকস্তুরী, ইউনানি মতে এর নাম হাব্ব-উল-মুশক এবং ইংরেজী নাম আমব্রেট।

অপরিমেয় ঔষধি গুণ সম্পন্ন এই ভেষজ উদ্ভিদটির প্রায় প্রতিটি অংশ কোনো না কোনোভাবে ব্যবহৃত হয়। কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, চায়না ও ভারতে এর বাণিজ্যিক চাষ হয়।

লতাকস্তুরী একটি বার্ষিক বা দ্বিবার্ষিক ভেষজ উদ্ভিদ। নরম লোমযুক্ত কাণ্ড এক-দুই মিটার উঁচু হতে পারে, পাতাগুলো সাধারণত পাঁচ-সাত ভাগ করা ত্রিভুজাকার। ফুল তিন-চার ইঞ্চি বড় হয় উজ্জ্বল হলুদ রংয়ের ওপর বেগুনী আভা। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ফুল ফোটে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বীজ সংগ্রহ ও মার্চ-এপ্রিলে বীজ রোপণ করা হয়। চাষে বিশেষ কোনো পরিচর্যার দরকার হয় না। যেকোনো পরিত্যাক্ত জায়গায় এর চাষ করা য়ায়।

বীজে কিটোন এবং আ্যাামব্রেটেলাইডের উপস্থিতি থাকায় এটি কস্তুরী গন্ধযুক্ত। বীজের রং ধূসর বাদামী। বীজ থেকে নিষ্কাশিত তেল অ্যারোমাথেরাপি, হতাশা, উদ্বেগ, এবং নার্ভসনেসের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। বীজের তেল সুগন্ধি হওয়ায় প্রসাধনী শিল্পে এর ব্যবহার রয়েছে। লতাকস্তুরীর মূল ও শিকড়ে এক ধরনের আঠালো পদার্থ পাওয়া যায়, যা সুতা ও কাগজ তৈরির শিল্পে ব্যবহৃত হয়।

লতাকস্তুরীর বীজে অ্যান্টিপাইরেটিক, অ্যান্টিহাইস্টেরিক, কার্মিনেটিভ, অ্যাফ্রোডিসিয়াক, অ্যান্টিস্পাসমোডিক, অ্যান্টিভেনম ও নার্ভাইন রয়েছে।

আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি চিকিৎসায় লতাকস্তুরীর বীজ হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, ডায়রিয়া, গনোরিয়া, হিস্টিরিয়াসহ ইউরোজেনিটাল সমস্যার মতো রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। বীজের বাতজ্বর, স্নায়বিক ব্যাধি, গলা ব্যথা এবং হিস্টিরিয়া নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। লতাকস্তুরীর ফুল গর্ভনিরোধক হিসাবেও ব্যবহার হয়। মুখের আলসার, মাড়ির রক্তপাত, আলগা দাঁত এবং মুখের দুর্গন্ধের মতো সমস্যা সারাতে কোমল ফল চিবিয়ে খেতে দেওয়া হয়। এর কচি ফল সবজি হিসেবে খাওয়া যায়।

গৌরনদী উপজেলার চরগাধাতলী গ্রামের নুর জাহান বেগম (৮০) কালের কণ্ঠকে বলেন, এক সময় আমাদের আখ মাড়াই হতো। আমরা বন ঢেড়শ (লতাকস্তুরী) পাতা ও কচি ডগা থেতো করে এক ধরনের জেলি বের করে আখের রসের সাথে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করতাম। এতে গুড় পরিষ্কার ও স্বচ্ছ দেখাতো। এখন এটি ব্যবহার হয় না। এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও ছিল না। আবার এ গাছ (লতাকস্তুরী) পাটের মতো জাগ দিয়ে সুতা তৈরি করতাম যা দিয়ে সিকা, জায়নামাজসহ বিভিন্ন কুটির শিল্পের জিনিসপত্র তৈরি করেছি।

সাপুড়ে মিজানুর রহমান ও শুক্কুর আলী বলেন, আমরা সাপে কাটা রোগীকে লতাকস্তুরীর বীজ দিয়ে একটি পথ্য খেতে দেই। এতে ভালো উপকার পাওয়া যায়।

গৌরনদীর মা বাবার দোয়া বানিয়াতি দোকানের মালিক প্রবীণ কবিরাজ আলতাফ হোসেন খান (৮৫) কালের কণ্ঠকে বলেন, আগে জংলা থেকে লতাকস্তুরীর সংগ্রহ করতাম। এখন পাওয়া যায় না। এখন ঢাকার চক বাজার থেকে প্রতি কেজী ১২শ টাকা দরে কিনে আনি।

আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ ডা. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, লতাকস্তুরী নামক গাছটির অনেক ঔষধি উপকারিতা রয়েছে। আমাদের দেশে হারবাল ঔষধশিল্পে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে যা আমদানি নির্ভর। এর পরিকল্পিত চাষে যত্নবান হওয়া দরকার।

Share this post

PinIt
scroll to top