ধরন বদলে সারাদেশে দ্রুত ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু

dangue-do.jpg

দেশের তথ্য ডেস্ক:-

এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু সারাদেশেই মহামারি আকারে ছড়াচ্ছে। এরই মধ্যে লার্ভার জন্ম ও কামড়ানোর ধরনেও পরিবর্তন এসেছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। গত কয়েকদিন পাঁচ-সাতশ করে আক্রান্ত হলেও সবশেষ দুদিন এ সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে।

চলতি বছর জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬ হাজারের বেশি মানুষ। শুধু জুলাইয়ের ১২ দিনে এ সংখ্যা ছাড়িয়েছে আট হাজার। এবার এখন পর্যন্ত গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা ও সুনামগঞ্জ ছাড়া দেশের সব জেলায়ই ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। ঢাকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঢাকার বাইরেও বাড়ছে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ডেঙ্গুর সংক্রমণ সামান্য থাকলেও মে মাস থেকে ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়। মে মাসেই ১০৩৬ জন আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি মৃত্যু হয় দুজনের। জুন মাসে তা কয়েকগুণ বেড়ে হাসপাতালে ভর্তি হন পাঁচ হাজার ৯৫৬ জন। জুলাই মাসে এসে এ চিত্র পুরোপুরি বদলে গেছে। এই মাসের প্রথম ১২ দিনেই আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট হাজার ১৬৫ জনে। আর মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। প্রতিদিনই বাড়ছে এ সংখ্যা।

 

এবার বর্ষার আগেই এ রোগের সংক্রমণ বাড়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ার আশঙ্কার কথা জানানো হয়। বিশেষজ্ঞরাও বলে আসছিলেন একই কথা।

এ অবস্থায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে হাসপাতালে হাতেগোনা কয়েকজন চিকিৎসক-নার্স দিয়ে ডেঙ্গুর চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া কঠিন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার উপ-পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে মৌখিকভাবে ঘোষণা হয়েছে।

তবে কখন থেকে পুরোপুরি ডেডিকেটেডভাবে ডেঙ্গুরোগী ভর্তি করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ঘোষণা করার জন্য পর্যাপ্ত লোকবল ও সরঞ্জামের ব্যবস্থা এখনো হয়নি। তা হয়ে গেলে শিগগির পুরোপুরি ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণা করা হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালে দেশে এক বছরে সবচেয়ে বেশি এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হন, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও আক্রান্ত হন ১৪০৫ জন ও মারা যান ৭ জন।

এরপর ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জন মারা যান। গত বছর ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। মারা যান ১৮১ জন।

২০২৩ সালে এসে ২০১৯ সালের সর্বোচ্চ রেকর্ডও ভেঙে ফেলার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে জুলাইয়ের প্রথম ১২ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন আট হাজার ১৬৫ জন। আর মারা গেছেন ৩৬ জন। এছাড়া গত ছয় মাসে ঢাকার বাইরে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ১ হাজার ৮৯৯ জন। কিন্তু গত ১১ দিনে শুধু ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৭০৬ জন। সামনে আরও ব্যাপক আকারে ছড়ানোর আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের তৃতীয়তলার ১৩ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে ২৭ নম্বর বিছানায় ভর্তি কাঁঠালবাগান এলাকার ৯ মাস বয়সী তানিম। তার মা সুমি বলেন, এক সপ্তাহ আগে জ্বর আসার পর চারদিন বাড়িতে সিরাপ খাওয়াই, পরে বমি ও পাতলা পায়খানা শুরু হয়। শনিবার শিশু হাসপাতালে ভর্তির জন্য গেলে শয্যা না থাকায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসি।

তিনি বলেন, এখানে ভর্তি হলেও পরীক্ষা করতে কষ্ট হওয়ায় শিশু হাসপাতালে পরীক্ষা করাচ্ছি। শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গুর তিনটা পরীক্ষা ১৮শ টাকা লেগেছে। এখানে সিবিসি টেস্ট দেড়শ টাকা।

পাশের বিছানায় পাঁচ বছর বয়সী তানহা আফরিন ভর্তি। তার বাবা তরিকুল ইসলাম জানান, তারা পরিবারসহ শ্যামলী এলাকায় থাকেন। গত শুক্রবার জ্বর এলে তানহাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে আসি। এরপর থেকে চিকিৎসা চলছে। এখন তুলনামূলক ভালো।

তিনি আরও জানান, এলাকার আশপাশে নালা-নর্দমা আছে। সেখানে মশার উৎপত্তি হতে পারে। বাসায় তো শিশুকে মশারি দিয়ে রাখি। তবে কীভাবে কখন হয়েছে কি হলো বলতে পারছি না।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে ২১ জন। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি মোট ৬০ জন ডেঙ্গুরোগী। এ নিয়ে হাসপাতালটিতে ভর্তি হওয়া মোট ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা ২৮২ জন। এমন চিত্র রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতালে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, একটি মশা তিন থেকে চারদিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে। এর মধ্যে সে ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে যতজন মানুষকে কামড়ানোর সুযোগ পায় ততজনকেই আক্রান্ত করতে পারে।

একটি মশা চার-পাঁচজনকে দিনে কামড়াতে পারে। তবে মশা যদি চুপিসারে রক্ত চুষে নিতে পারে তখন একজন থেকেই তার মাত্রা অনুযায়ী রক্ত নিতে পারে, যা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। তবে কতজনকে একটি মশা আক্রান্ত করতে পারে তার নিশ্চয়তা নেই। এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও নেই।

তিনি বলেন, এবছর অতীতের সব রেকর্ড ভাঙার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাধারণভাবেই ডেঙ্গুর উপদ্রব বাড়বে। এরই মধ্যে ডেঙ্গুর সংক্রমণ চোখ রাঙানো শুরু করেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মৃত্যু এবং আক্রান্ত দুটিই দেশের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড গড়বে।

কবিরুল বাশার বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে পরিষ্কার পানি ছাড়াও এডিস মশা সুয়ারেজের পানি, ড্রেনের পানি এমনকি সমুদ্রের নোনা পানিতেও ডিম পাড়ে এবং তার জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে। আগে আমরা ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজননস্থল হিসেবে পরিষ্কার পানির কথা জানলেও তা এখন পরিবর্তিত হয়েছে।

সারাদেশেই ডেঙ্গুর প্রকোপ, ধরন বদলে ছড়াচ্ছে দ্রুত

তিনি আরও বলেন, এক সেন্টিমিটার পরিমাণ জমে থাকা পানিতেও আমরা এডিস মশার বংশবৃদ্ধির প্রমাণ পেয়েছি। এর আগে আমরা জানতাম এডিস মশা শুধু দিনের বেলায়, বিশেষ করে সকালে এবং বিকেলে কামড়ায়। কিন্তু আমাদের গবেষণায় সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের ল্যাবরেটরি ও মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় আমরা পেয়েছি এডিস মশা রাতেও কামড়ায়। তবে রাতে কামড়ানোর হার কম। পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং মানুষের আচরণের কারণে এই মশা অত্যন্ত সুচতুরভাবে নিজেকে পরিবর্তিত করে নিয়েছে।

এবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, প্রথমবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হলে শারীরিক পরিস্থিতির বেশি অবনতি হয়। এবছর সন্দেহ করা হচ্ছে ডেঙ্গুর ডেন-২ ধরন বেশি। তবে ড্রেন বা সেরোটাইপ যে ধরনেরই আক্রান্ত হোক সেটি বড় বিষয় নয়, একাধিকবার আক্রান্তদের ঝুঁকি বেশি। এবার দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার আক্রান্ত বাড়ছে। জটিলতাও বেশি দেখা দিচ্ছে। এরপরও অনেকে ডেঙ্গুকে গুরুত্ব কম দিচ্ছেন।

‘যথাসময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন বা হাসপাতালে যেতে দেরি করছে। এতে রোগীর উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি, হার্টের সমস্যা, পেটে পানি জমা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিয়ে দ্রুত শক সিনড্রোমে চলে যাচ্ছে। তাই জ্বর দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করা যাবে না।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃতিতে এডিস মশার ঘনত্ব যেহেতু খুব বেশি নয়। আর আমরা এটাও জানি না কোন এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করছে কোনটি নয়। তাই আমাদের রাতে বা দিনে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনোভাবেই এডিস মশা কামড়াতে না পারে।

Share this post

PinIt
scroll to top