নিজেস্ব ডেস্কঃ-
নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে সরকার পতনের এক দফা দাবি ও নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি এবং দলটির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো। বুধবার (১২ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর নয়া পল্টনে ডাকা হয়েছে সমাবেশ। এই সমাবেশে বিপুল জমায়েত নিশ্চিত করতে সব প্রস্তুতি সেরে এনেছে বিএনপি। তবে রাজপথে বিরোধী দলগুলোকে একপাক্ষিক সুযোগ দিচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একই দিন একই সময়ে ক্ষমতাসীন দলটিও ডেকেছে শান্তি সমাবেশ। নেতাকর্মীদের দেওয়া হয়েছে কঠোর অবস্থানে থাকার নির্দেশনা।
একই দিনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মসূচি থাকায় রাজপথ উত্তপ্ত হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করছে রাজনৈতিক দলগুলো। এরইমধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে ‘চক্রান্তের’ অভিযোগ করা হয়েছে। দলটির নেতারা অভিযোগ করেন—আওয়ামী লীগই একই দিনে কর্মসূচি ডেকে ‘পায়ে-পা রেখে’ পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে চাইছে। জবাবে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বিএনপি-জামায়াত যেন সমাবেশের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে না পারে, সে ব্যাপারে তারা সতর্ক থাকবে।
একাধিক রাজনীতিক জানিয়েছেন, যেহেতু এরইমধ্যে ঢাকায় বিদেশি প্রতিনিধি দল রয়েছে—সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় পক্ষ থেকেই সংঘর্ষের শঙ্কা প্রায় নেই। এক্ষেত্রে কোনও ‘ইনসিডেন্ট’ ঘটলে তাতে ভিন্ন কোনও রহস্য থাকতে পারে।
রাজধানী ঢাকায় সমাবেশ করে বুধবার (১২ জুলাই) ‘সরকার পতনের এক দফা’ ঘোষণার হুমকি দিয়েছে বিএনপি। অপরদিকে এদিন রাজপথে কড়া অবস্থানে থাকবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে না পারে, সেজন্য দলটির নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক দলগুলো এতে যোগ দিচ্ছে না।
বুধবার (১২ জুলাই) বিকাল ৩টায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে ‘শান্তি সমাবেশ’ করবে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। ‘বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে’ ডাকা এ কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদেরও যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফীর সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতারা অংশ নেবেন।
সমাবেশের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী বলেন, ‘শান্তি সমাবেশ সফল করতে প্রতিটি থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিটের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী এতে অংশ নেবেন। তারা কড়া অবস্থানে থেকে রাজপথ নিজেদের দখলে রাখবেন। বিএনপি-জামায়াত যেন সমাবেশের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে না পারে, সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক থাকবো।’
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, ‘বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটের শান্তি সমাবেশ সফল করতে যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কড়া অবস্থানে থাকবেন এই সমাবেশে। তবে আমরা কোনও ধরনের সংঘাত বা সহিংসতা চাই না। বিএনপি-জামায়াত ঝামেলা করতে চাইলে ছেড়ে দেওয়া হবে না।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচন থাকায় ঢাকা মহানগর উত্তরে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করার ব্যাপারে আইনি বিধিনিষেধ রয়েছে। সে কারণে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সঙ্গে মিলে যৌথভাবে এই শান্তি সমাবেশে অংশ নেবো আমরা। মিছিল নিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানার নেতারা সমাবেশে যোগ দেবেন।’
এদিকে, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের এই শান্তি সমাবেশে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বলেছেন, সাম্প্রতিক কর্মসূচি পৃথকভাবে পালন করা হলেও বুধবারের কর্মসূচি সব সংগঠনের সমন্বয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিএনপির কর্মসূচির দিন আওয়ামী লীগের সমাবেশ থাকলেও কোনও কর্মসূচি নেই দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর। তারা আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতেও যোগ দিচ্ছে না বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘বিএনপির কর্মসূচির দিন ১৪ দলের কোনও কর্মসূচি নেই। দলীয় কোনও কর্মসূচিও নেই জাসদের। আমরা আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সভা-সমাবেশ করছি।’
১৪ দলের আরেক শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘জোটের মেইন কম্পোনেন্ট হলো আওয়ামী লীগ। তারা তাদের মতো করে শান্তি সমাবেশ করছে। আমরা আমাদের কর্মসূচি পালন করছি। বুধবার বিএনপির কর্মসূচির দিন আমাদের কোনও কর্মসূচি নেই।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও যুগপতে যুক্ত দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আভাস পাওয়া গেছে, বুধবারের সমাবেশ থেকে সরকার পতনের একদফা দাবি ঘোষণা করা হবে। একইসঙ্গে দাবি মানাতে কর্মসূচি দেবে তারা। সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কর্মসূচি জানাবেন। আর যুগপতে যুক্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কোনও কোনও দল সমাবেশ ও বেশিরভাগ দল সংবাদ সম্মেলন করে এই দাবি জানাবে।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, বুধবার বিএনপির সঙ্গে যুগপৎভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করবে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, গণফোরাম, গণঅধিকার পরিষদ (নুর), গণঅধিকার পরিষদ (রেজা), গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, সমমনা গণতান্ত্রিক পেশাজীবী জোট, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।
‘যুগপৎ ধারায় বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের এক দফার যৌথ ঘোষণা’ শিরোনামে সম্ভাব্য ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়েছে— ‘বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী বর্তমান ফ্যাসিবাদী, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পদত্যাগ ও বিদ্যমান অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি, রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত ও তার গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে রাজপথে সক্রিয় বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো যুগপৎ ধারায় ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর গণআন্দোলন গড়ে তোলা ও তা সফল করার ঘোষণা প্রদান করছে।’
গণতন্ত্র মঞ্চের একাধিক নেতা জানান, এই এক দফা ঘোষণার ক্ষেত্রে গণতন্ত্র মঞ্চ খালেদা জিয়ার নামের আগে ‘দেশনেত্রী’ শব্দটি উল্লেখ না করে বিএনপির চেয়ারপারসন উল্লেখ করবে। কোনও কোনও দল বিএনপি যেভাবে প্রস্তাব করেছে, সেভাবেই উপস্থাপন করবে।
এক দফার সঙ্গে বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা হিসেবে ৩১ দফার ঘোষণাও দেওয়া হবে। যৌথভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা নিয়ে ঐকমত্য না হওয়ায় গণতন্ত্র মঞ্চের ৩১ দফার সঙ্গে কিছুটা পার্থক্য থাকবে। এছাড়া অন্য দলগুলো বিএনপির রূপরেখাকেই ফলো করবে বলে জানান কোনও কোনও নেতা।
বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতা জানান, তারেক রহমান ঘোষিত ২৭ দফার বর্ধিত সংস্করণই হচ্ছে ৩১ দফা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও সিনিয়র কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে তারা জানিয়েছেন, বুধবারের সমাবেশে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্ত থাকতে পারেন। তবে তিনি বক্তব্য দেবেন কিনা তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেননি। আরেক ভাইস চেয়ারম্যান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বক্তব্য দেওয়ার সম্ভাবনা কম।’
সরকার পতনের কর্মসূচির দিন ক্ষমতাসীন দলের কর্মসূচি থাকায় বিএনপি ও বিরোধী দলের নেতারা আশঙ্কা করছেন পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখে আসছি, বিএনপি যখন প্রোগ্রাম ঘোষণা করে, আওয়ামী লীগ তখন পাল্টা কর্মসূচি দেয়। আওয়ামী লীগ যে গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকারে বিশ্বাস করে না, এটা তারই প্রমাণ। আমরা কিন্তু আমাদের সব প্রোগ্রাম চালিয়ে নিয়েছি। আমাদের নেতাকর্মীরা তাদের হামলায় আহত হয়েছেন, নিহত হয়েছেন আমাদের অনেক কর্মী। আওয়ামী লীগ আপাদমস্তকে গণতন্ত্রবিরোধী দল, গণতন্ত্রে তাদের বিশ্বাস নেই।’
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘আওয়ামী লীগ পাল্টা প্রোগ্রাম দেয় পায়ে পাড়া দিয়ে সংঘর্ষ করতে। আমরা চাই গণতান্ত্রিক আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের আন্দোলন। দেশের মানুষ আর তাদের রক্তচক্ষুকে ভয় করে না। তারা ১৫ বছর মানুষকে ভয় দেখিয়ে শাসন করেছে। এবারের আন্দোলন মানুষের সেই অর্জিত গণতন্ত্রকে ফেরানোর চূড়ান্ত আন্দোলন।’
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক সাইফুল হক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে উসকানিমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। বিরোধী দল যতই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি রাখার চেষ্টা করে, সরকার ততই বিকল্প ব্যবস্থা করে শান্তি নষ্ট করতে।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘সাধারণত বিরোধী দল প্রোগ্রাম দিলে সরকারি দল দেয় না, কিন্তু সরকার পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাঁধাতে চায়। এটা আসলে আওয়ামী লীগ সরকারের নার্ভাসনেসের কারণে। তারা বেসামাল হওয়ায় জোরজবরদস্তি করে দলের লোকদের নামাচ্ছে রাজপথে। এটা আসলে আওয়ামী লীগের অসহায়ত্বের প্রকাশ। ফলে, বুধবার কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে এর পুরো দায় সরকারের।’