চট্টগ্রাম বন্দরে এই প্রথম স্মার্ট পদ্ধতিতে তেল খালাস শুরু করলো। এতে জ্বালানি তেল ব্যবস্থাপনায় নতুন যুগে পদার্পণ করল বাংলাদেশ। মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) বয়া থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরীক্ষামূলক খালাস চলছে।
রোববার বিকেল ৪টার দিকে প্রথমবারের মতো গভীর সমুদ্রের মুরিং থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারি প্ল্যান্টে অপরিশোধিত তেল পরিবহন কার্যক্রম শুরু হয়। এমটি হোরে জাহাজে সৌদি আরব থেকে আনা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে খালাস দেশের ইতিহাসে প্রথম। গভীর সমুদ্র থেকে ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন দিয়ে জ্বালানি তেল খালাস কার্যক্রম শুরু করেন।
সাগরের তলদেশে স্থাপিত পাইপলাইনের মাধ্যমে গভীর সমুদ্র থেকে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত তেল মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নে স্থাপিত স্টোরেজ ট্যাংকে জমা হবে।
এরপর সেখান থেকে ১১৬ কিলোমিটার দূরে পতেঙ্গায় অবস্থিত ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) ট্যাংকে তেল পাঠানো হবে। আগে বন্দরের বহির্নোঙরে ভেড়া ট্যাংকার থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে তেল খালাস করা হতো।
এ জটিল প্রক্রিয়ায় সময় ও অর্থ বেশি লাগত। ১১-২০ দিন লাগত এবং তেলের অপচয়ও হতো। নতুন পদ্ধতিতে তেল খালাসের সময় লাগবে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা। এ পদ্ধতিতে তেল খালাসে বছরে অন্তত ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
সূত্র জানায়, ৮২ হাজার টন ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত তেল) নিয়ে আসা এমটি হোরে জাহাজ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাহাজ। সাধারণত এতদিন চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টন ধারণক্ষমতার জাহাজ বা অয়েল ট্যাংকার আসত।
কক্সবাজারের মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে সিঙ্গেল মুরিং পয়েন্টে এক লাখ টনেরও অধিক ধারণক্ষমতার সুপার ট্যাংকার ভিড়তে পারবে। ২৪ জুন সিঙ্গেল মুরিং বয়া এলাকায় এমটি হোরে ভেড়ানো হয়। পরদিন তেল খালাস শুরুর কথা থাকলেও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল বলেন, দেশের ইতিহাসে বিশালাকার মাদার ট্যাংকার থেকে সমুদ্রে স্থাপিত ভাসমান বয়ায় তেল খালাস শুরু হচ্ছে।
দেশের জ্বালানি তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে এটি একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী অধ্যায়। স্মার্ট বাংলাদেশে একটি ‘স্মার্ট টেকনোলজির’ সংযোজন হলো। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাবে। বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
আগে বহির্নোঙরে লাইটারিংয়ের মাধ্যমে একটি জাহাজ থেকে তেল খালাস করতে সময় লাগত ১১ থেকে ২০ দিন। এখন লাগবে মাত্র দুই দিন। অতিরিক্ত সময় বসে থাকার জন্য জাহাজপ্রতি দিনে ৩০-৪০ হাজার ডলার গুনতে হতো। এখন এ টাকা সাশ্রয় হবে। রিজার্ভ সমৃদ্ধ হবে। ছোট ছোট লাইটার জাহাজের কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষিত হতো।
খালাসের সময় কিছু তেল সাগরেও পড়ত। এখন এ রকম কিছুই হবে না। তিনি আরও বলেন, আমরা এ ধরনের জাহাজ হ্যান্ডলিং করতে সক্ষম। তাই বিপিসি যে কোনো সময় পুরোদমে পাইপলাইনে তেল সরবরাহ শুরু করলে আমরা সাপোর্ট দিতে পারব। এজন্য আমরা প্রস্তুত।
বিপিসি-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে সরকারিভাবে সমুদ্রপথে বছরে ৬০ লাখ টনেরও বেশি জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা এবং কর্ণফুলী নদীর চ্যানেলের নাব্য কম হওয়ায় মাদার অয়েল ট্যাংকারগুলো থেকে ইআরএলের ট্যাংকারে সরাসরি তেল খালাস করা সম্ভব হয় না। এর ফলে এসব ট্যাংকার গভীর সমুদ্রে নোঙর করতে হয়।
এরপর ছোট ছোট লাইটারেজ ভেসেলের মাধ্যমে অপরিশোধিত তেল খালাস করা হয়। এতে একেকটি জাহাজ থেকে তেল খালাস করতে সময় লেগে যায় ১১ থেকে ২০ দিন। এ পদ্ধতি সময়সাপেক্ষ, ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল হওয়ায় ২০১৫ সালে পাইপলাইন বসানোর প্রকল্পটি (সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং) হাতে নেওয়া হয়।
৪ হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু নানা কারণে ইতোমধ্যেই প্রকল্পের মেয়াদ তিনবার বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বেড়ে ৭ হাজার ১২৫ কোটি টাকায় ঠেকেছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে খরচ আরেকটু বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিপিসির এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। মহেশখালীতে দুই লাখ টন ধারণক্ষমতার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে মহেশখালী থেকে ১১৬ কিলোমিটার দূরে পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড পর্যন্ত পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরে ৯০ লাখ টন পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করা যাবে। এর মাধ্যমে সময় সাশ্রয় হওয়ার পাশাপাশি বছরে অন্তত ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) নামের এ প্রকল্পের আওতায় ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন কাজও শেষ হয়েছে। তবে প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হতে আরও সময় লাগবে।
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান বলেন, `আমরা সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) এর সাথে সৌদি আরব থেকে ৮২০০০ টন অপরিশোধিত তেল নিয়ে আসা এমটি হোরাই জাহাজের সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি।
এর মাধ্যমে দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটবে এবং জ্বালানি খাতে বাংলাদেশ এক নতুন যুগে প্রবেশ করবে। গত ২৫ জুন কমিশনিং হওয়ার কথা থাকলেও সাগর উত্তাল থাকায় তা সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্পের অধীনে দুটি সমান্তরাল পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। যার একটি অপরিশোধিত তেলের জন্য এবং অন্যটি ডিজেলের জন্য। গভীর সমুদ্রে একটি ভাসমান মুরিং পয়েন্ট এবং মহেশখালীতে একটি স্টোরেজ ট্যাংক টার্মিনাল রয়েছে।
এখন অপরিশোধিত তেল পরিবহন হচ্ছে। অপর পাইপলাইনে ডিজেল এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য তেল পরিবহন করা হবে। পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল পরিবহণ করার কারণে জ্বালানি তেল পরিবহন সাশ্রয় হওয়ার পাশাপাশি অপচয় বন্ধ হবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এর মতে, বিপিসি চীনের এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নে ৭ হাজার ১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ২০১৫ সালে পাশ হওয়া এ প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ছিল ৪৯৩৫ কোটি টাকা এবং প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল।